Chapter- 12 আহার ও পানীয় ( প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য )
প্রশ্নোত্তরঃ
১। অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরঃ
(ক) স্বামী বিবেকানন্দের পূর্ব নাম
কী ছিল?
উত্তরঃ স্বামী
বিবেকানন্দের পূর্ব নাম ছিল বীরেশ্বর।
(খ) শঙ্করাচার্য কে ছিলেন?
উত্তরঃ
শঙ্করাচার্য ছিলেন সুপ্রসিদ্ধ দার্শনিক পণ্ডিত। দাক্ষিণাত্যের মালাবার অঞ্চলে তাঁর
আবির্ভাব। শঙ্করাচার্যের মতাবলম্বীরা তাঁকে শিবের অবতার বলে মনে করেন।
(গ) কারা বুনো হাঁসের ডিম খেতে
ভালোবাসে?
উত্তরঃ
কাশ্মীরীরা বুনো হাঁসের ডিম খেতে ভালোবাসে।
(ঘ) ‘আহার ও পানীয়’ রচনাটি কোন গ্রন্থ থেকে চয়ন করা হয়েছে?
উত্তরঃ ‘আহার ও পানীয়’ রচনাটি স্বামী বিবেকানন্দের ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ নামক গ্রন্থ থেকে চয়ন করা হয়েছে।
(ঙ) বাংলাদেশে ও পাঞ্জাবে মাংসকে কী
বলা হয়?
উত্তরঃ বাংলাদেশে
ও পাঞ্জাবে মাংসকে মহাপ্রসাদ বলা হয়।
(চ) রাজপুতদের ধর্মীয় বাদ্য কী?
উত্তরঃ বুনো মোর
শিকার করে খাওয়া রাজপুতদের ধর্মীয় খাদ্য।
২। সংক্ষিপ্ত উত্তরের জন্য প্রশ্নঃ
(ক) আচার্য রামানুজ ভোজ্যদ্রব্য
বিষয়ে কোন তিনটি দোষ সম্পর্কে সাবধান
করেছেন?
উত্তরঃ আচার্য
রামানুজ ভোজ্যদ্রব্য বিষয়ে যে তিনটি দোষ সম্পর্কে সাবধান করেছেন তা হল–
(ক) জাতিদোষ অর্থাৎ যে দোষ ভোজ্যদ্রব্যের জাতিগত, যেমন প্যাঁজ লণ্ডন ইত্যাদি উত্তেজক দ্রব্য খেলে মনে অস্থিরতা আসে
অর্থাৎ বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়।
(খ) আশ্রয় দোষ অর্থাৎ যে দোষ ব্যক্তি বিশেষের স্পর্শ হতে আসে দুষ্ট
লোকের অন্ন খেলেই দুষ্টবুদ্ধি আসবেই, সতের অন্নে সদবুদ্ধি ইত্যাদি।
(গ) নিমিত্ত দোষ অর্থাৎ ময়লা কদর্য কীট কেশাদি দুষ্ট অন্ন খেলেও মন অপবিত্র হবে।
এর মধ্যে জাতিদোষ
এবং নিমিত্ত দোষ থেকে বাঁচবার চেষ্টা সকলেই করতে পারে, কিন্তু আশ্রয় দোষ থেকে বাঁচা সকলের পক্ষে সহজ নয়।
(খ) ভারতে এবং বিদেশে গরীবের আহার কী?
উত্তরঃ লেখকের
মতে ভারতে বা সর্বদেশেই গরীবের খাওয়া ধান্য বিশেষ। যে দেশে যে শস্য প্রধান ফসল
গরিবের প্রধান খাদ্য সেটাই। যেমন – বাংলা ও উড়িষ্যায়, মাদ্রাজ উপকূলে ও মালাবার উপকূলে ভাত প্রধান খাদ্য। তার সঙ্গে ডাল
তরকারি কখনও কখনও মাছ-মাংস চাটনিবৎ। শাক, তরকারি, ডাল, মাছ, মাংস সমস্ত কিছুই ঐ ভাত ও রুটির সঙ্গে খাওয়া হয়। ভারতবর্ষে রুটি ও
ভাতই প্রধান খাদ্য গরিব, ধনী সবার জন্য।
তবে পাশ্চাত্য
দেশে যে সকল গরিব দেশ আছে বা ধনী দেশের গরিবদের মধ্যেও রুটি এবং আলুর প্রধান
খাদ্য। মাংসের চাটনি কালেভদ্রে চলে। স্পেন, পর্তুগাল ইত্যাদি দেশে
দ্রাক্ষাওয়াইন বেশি পরিমাণে জন্মায় ও সস্তাও হয়। এবং তা যথেষ্ট পুষ্টিকর। তাই
সে দেশের গরিবেরা মাছ মাংসের জায়গায় দ্রাক্ষারস গ্রহণ করে। কিন্তু রুশিয়া, সুইডেন, নরওয়ে প্রভৃতি দেশে দরিদ্র লোকের আহার প্রধানত রাই নামক ধান্যের
রুটি ও একটুকরা শুটকি মাছ ও আলু।
(গ) দুধ খাওয়ার নিয়ম সম্বন্ধে
বিবেকানন্দ কী বলেছেন?
উত্তরঃ দুধ
খাওয়ার নিয়ম সম্বন্ধে বিবেকানন্দ বলেছেন যে দুধ পেটে অম্লাধিক্য হলে একেবারে
দুষ্পাচ্য এমন কি একদমে এক গ্লাস দুধ খেয়ে কখন কখন সদ্য মৃত্যু ঘটেছে। শিশু যেমন
মাতৃস্তন্য পান করে সেরকম ঢোকে ঢোকে খেলে তবে শীঘ্র হজম হয়, নতুব। অনেক দেরি লাগে। দুধ একাট গুরুপাক জিনিস, মাংসের সঙ্গে হজম আরও গুরুপাক, কাজেই এ নিষেধ ইহুদীদের মধ্যে।
মূর্খ মাতা কচি ছেলেকে জোর করে ঢক ঢক করে দুধ খাওয়ায়, আর দু-ছ মাসের মধ্যে মাথায় হাত দিয়ে কাঁদে। লেখক বলেছেন যে, এখনকার ডাক্তারেরা পূর্ণ বয়স্কদের জন্যও এক পোয়া দুধ আস্তে আস্তে
আধ ঘণ্টায় খাওয়ার বিধি দেন, কচি ছেলেদের জন্য ‘ফিডিং বটল’ ছাড়া উপায়ন্তর নেই। সেকালে আঁতুর ঘর দুধ খাওয়ানো প্রভৃতি হাত থেকে
যে ছেলেপিলেগুলো বেঁচে উঠত, সেগুলো এক রকম সুস্থ সবল আজীবন থাকত।
(ঘ) ইহুদীদের আর হিন্দুদের অনেক
সৌসাদৃশ্য খাওয়া সম্বন্ধে” – বিবেকানন্দের অনুসরণে উভয়ের খাওয়ার সাদৃশ্য সম্বন্ধে লেখো?
উত্তরঃ ইহুদীদের
আর হিন্দুদের খাওয়া সম্বন্ধে অনেক সাদৃশ্য আছে। লেখকের অনুসরণে বলা যেতে পারে
ইহুদীরা যে মাছে আঁশ নেই তা খাবে না, মোর খাবে না, যে জানোয়ার দ্বিশফ নয় এবং জাবর কাটে না, তাকেও খাবে না। আবার বিষম কথা দুধ বা দুগ্ধোৎপন্ন কোন জিনিস যদি
হেঁশেলে ঢোকে যখন মাছ, মাংস রান্না হচ্ছে তখন তা সব ফেলে দিতে হবে। তারপর গোঁড়া ইহুদীরা সব
ফেলে দিতে হবে। তারপর গোঁড়া ইহুদীরা তথ্য কোনো জাতির রান্না খায় না। আবার হিদুর
মতো ইহুদীরা বৃথা মাংস খায় না। যেমন বাংলাদেশে ও পাঞ্জাবে মাংসের নাম ‘মহাপ্রসাদ’। ইহুদীরা সেই প্রকার ‘মহাপ্রসাদ’ যথা নিয়মে বলিদান না হলে খায় না। তাই হিদুর মতো ইহুদীদের ও যেকোনো
দোকান থেকে মাংস কেনার অধিকার নেই। মুসলমানেরা ইহুদীদের অনেক নিয়ম মানে, তবে এত বাড়াবাড়ি করে না। ইহুদীরা বুনো শুয়োর খায় না, হিন্দুরা খায়। পাঞ্জাবে মুসলমান হিদুর বিষম সংঘাত থাকায় বুনো
শুয়োর হিদুরে অত্যাবশ্যক খাবার হয়ে দাড়িয়েছে। রাজপুতদের মধ্যে বুনো মোর শিকার
করে খাওয়া একটা ধর্ম বিশেষ। দক্ষিণ দেশে ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্যান্য জাতের মধ্যে
গেঁয়ো মোরও যথেষ্ট চলে। হিদুরা বুনো মুরগী খায়, গেঁয়ো খান না। বাংলাদেশ থেকে নেপাল
ও আকাক্ষীর হিমালয়ে এক রকম চালে চলে।
৩। দীর্ঘ উত্তরের জন্য প্রশ্নঃ
(ক) “আহার শুদ্ধ হলে মন শুদ্ধ হয়’ – বিবেকানন্দের অনুসরণে মন্তব্যটি আলোচনা করো?
উত্তরঃ লেখক
আলোচ্য মন্তব্যটিতে বলতে চেয়েছেন যে আহার এর সঙ্গে মনের এক গভীর সম্পর্ক আছে।
আহার শুদ্ধ হলে মন শুদ্ধ হয় এটা শাস্ত্রের কথা। কিন্তু শঙ্করাচার্যের মতে ‘আহার’ শব্দের অর্থ ইন্দ্রিয়লব্ধ বিষয়জ্ঞান আর রামানুজাচার্যের মতে
ভোজ্যদ্রব্য। লেখক বলেছেন এই দুই সিদ্ধান্তই ঠিক। বিশুদ্ধ আহার না হলে
ইন্দ্রিয়সকল যথাযথ কার্য করে না। আহারে ইন্দ্রিয়সকলের গ্রহণশক্তির হ্রাস হয় বা
বিপর্যয় হয়। এ কথা সকলেরই প্রত্যক্ষ। লেখক একথাও উল্লেখ করেছেন যে অজীর্ণ দোষে
এক জিনিসকে আর এক বলে ভ্রম হওয়া এবং আহারের অভাবে দৃষ্টি শক্তির হ্রাস হয়। আবার
কোনো বিশেষ আহার বিশেষ শারীরিক ও মানসিক অবস্থা উপস্থিত করে। তাই আমাদের সমাজে এত
খাদ্যের বাছ-বিচারও করা হয় এর ফলেই। রামানুজাচার্যের মতে পেয়াজ, রসুন খেলে মনে অস্থিরতা আসে ও বুদ্ধি ভ্রষ্ট হয় কারণ এগুলো উত্তেজক
দ্রব্য। তাই বলেছেন দুষ্ট লোকের অন্ন খেলে দুষ্ট বুদ্ধি আর ভালো লোকের অন্নে
সদবুদ্ধি হয়। নিমিত্ত দোষ অর্থাৎ ময়লা কদর্য কীট কেশাদি দুষ্ট অন্ন খেলেও মন
অপবিত্র হবে। আশ্রয় দোষ থেকে বাঁচা তাই সকলের পক্ষে সম্ভব নয়।
(খ) “জাতিদুষ্ট অন্নভোজন সম্বন্ধে ভারতবর্ষের মতো শিক্ষার স্থল এখনও
পৃথিবীতে কোথাও নাই।” — লেখকের অনুসরণে আলোচনা কর।
উত্তরঃ জাতিদুষ্ট
অন্নভোজন সম্বন্ধে ভারতবর্ষের মতো শিক্ষার স্থল এখনও পৃথিবীতে কোথাও নেই। কারণ সমস্ত
ভূমণ্ডলে আমাদের দেশের মতো পবিত্র দ্রব্য আহার করে, এমন আর কোন দেশে নেই। কারণ
নিমিত্তদোষ সম্বন্ধে বর্তমান কালে বড়ই ভয়ানক অবস্থা দাঁড়িয়েছে ময়রার দোকান, বাজারে খাওয়া, এ সব মহা অপবিত্র। লেখক বলেছেন ঘরে
ঘরে যে অজীর্ণ দেখা যায় তা ঐ ময়রাও দোকানে বাজারে খাওয়ার ফল। এমনকী প্রস্রাবের
ব্যারামের প্রকোপ ও ঐ ময়রার দোকানের ফল।
(গ) বর্তমান যুগে আহার সম্পর্কে
সর্বসাধারণের মত কী?
উত্তরঃ বর্তমান
যুগে আহার সম্পর্কে সর্বসাধারণের মত হল পুষ্টিকর অথচ শীঘ্র হজম হয়, এমন খাওয়া দাওয়া। অল্প আয়তনে অনেক বেশি পুষ্টি হয় আবার সেই আহার
শীঘ্র রান্নাও হয় এমন আহারই চায়। কারণ যে খাওয়ায় পুষ্টি কম সে খাবার অনেক
পরিমাণে খেতে হয় আর হজম হতেও অনেক সময় লাগে। তাই ভাজা জিনিসগুলো অপুষ্টি হজম কম
হয়। তাই ঘি, তেল গরম দেশে কম খাওয়াই ভাল। তবে ঘি এর বদলে মাখন খাওয়া যেতে পারে
তা হজম হয় শীঘ্র। আর ময়দার তুলনায় আটাই শ্রেষ্ঠ ও সুখাদ্য তাই সর্বজন সম্মত মতে
যেই আহার পুষ্টিকর ও শীঘ্র হজমেও সেই আহারই গ্রহণ করা শ্রেয়।
(ঘ) হিন্দুদের খাদ্যাভাস সম্পর্কে
বিবেকানন্দের মতামত তুলে ধরো।
উত্তরঃ বিভিন্ন
দেশ ও বিভিন্ন জাতির খাদ্যাভাস দেখে বিবেকানন্দ বলেছেন হিন্দুরাই ঠিক কারণ
হিন্দুদের জন্ম-কর্ম-ভেদে আহারাদি সমস্তই পৃথক। মাংস খাওয়া অবশ্য অসভ্যতা, নিরামিষ ভোজন অবশ্যই পবিত্রতর। যাঁর উদ্দেশ্য কেবলমাত্র ধর্মজীবন, তাঁরা পক্ষে নিরামিষ, তার বলেছেন যে এই সংসারে খেটে খুটে
দিবারাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন তাকে মাংস খেতে হবে। যতদিন
মনুষ্য সমাজে এই ভাব থাকবে –
‘বলবানের জয়’ ততদিন মাংস খেতে হবে বা মাংসের উপযোগী কোনো আহার আবিস্কার করার কথা
তিনি বলেছেন। কারণ এটা না করলে বলবানের পদতলে দুর্বল পিষে যাবে। রাম বা শ্যাম
নিরামিষ খেলেই হল না জাতির তুলনা করে দেখতে হবে। আবার নিরামিষাশীদের সম্পর্কে
বলেছেন যে তাদের মধ্যে ঝগড়া বেঁধেছে। কারণ একপক্ষ বলেছেন ভাত, আলু, গম, যব, জনার প্রভৃতি শর্করা প্রধান খাদ্যও কিছুই নয়, ওসব মানুষে বানিয়ছে, ঐ সব খেয়েই যত রোগ। শর্করা উৎপাদক খাবার রোগের ঘর।
ঘোড়া গরুকে পর্যন্ত ঘরে বসে চাল গম খাওয়ালে রোগী হয়ে যায়, আবার মাঠে ছেলে কচি ঘাস খেয়ে তাদের রোগ সেরে যায়। ঘাস শাক পাতা
প্রভৃতি হরিৎ সাজিতে শর্করা উৎপাদক পদার্থ কম। বনমানুষ
জাতি বাদাম ও ঘাস খায়, আলু গম ইত্যাদি খায় না, যদি খায় তো অপক্ক অবস্থার যখন
স্টার্চ অধিক হয়নি। এই সমস্ত নানা প্রকার বিতণ্ডা চলছে। একপক্ষ বলছেন, শূন্য মাংস আর যথেষ্ট ফল এবং দুগ্ধ এইমাত্র ভোজনই দীর্ঘ জীবনের
উপযোগী। সবার সম্মতি মতে পুষ্টিকর অথচ শীঘ্র হজম হয় এমন খাওয়াদাওয়া। অল্প
আয়তনে অনেকটা পুষ্টি অথচ শীঘ্র পাক হয়, এমন খাওয়া চায়। ভাজা জিনিসগুলো
আসল বিষ। তবে ঘিয়ের চেয়ে মাখন শীঘ্র হজম হয়। আর ময়দায় কিছুই নেই। আর সেটা
আটাই সুখাদ্য যেখানে গমের ভাগ সম্পূর্ণ থাকে। এমনকী আমাদের বাংলাদেশের দূর
পল্লীগ্রামেও সে আহার বন্দোবস্ত আছে তাই প্রশস্ত।
(ঙ) “অশুদ্ধ জল আর অশুদ্ধ ভোজন রোগের কারণ”। লেখকের অনুসরণে এই উক্তির ব্যাখ্যা করো।
উত্তরঃ লেখকের
অনুসরণে বলা যায়, অশুদ্ধ জল আর অশুদ্ধ ভোজন রোগের কারণ। আমেরিকায় জলশুদ্ধির বড়ই ধূম।
এমন যে ফিলটার তার দিন এমন চুকে গেছে। অর্থাৎ ফিলটার জলকে ছেঁকে নেয়
মাত্র, কিন্তু রোগের বীজ যে সকল কীটাণু তাতে থাকে, ওলাওঠা প্লেগের বীজ তা যেমন তেমনিই থেকে যায়। তার উপর ও ফিলটারটি স্বয়ং
ঐ সকল বীজের জন্মভূমি হয়ে দাঁড়ান। কলকাতা যখন প্রথম ফিলটার করা জল হল তখন পাঁচ বৎসর নাকি ওলাওঠা হয় নাই, তারপর যে কে সেই, অর্থাৎ সে ফিলটার মসাই এখন
স্বয়ং ওলাওঠা বীজের আবাস হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। ফিলটারের মধ্যে দিশি তেকাঠার ওপর ঐ যে
তিন কলসীর ফিলটার উনিই উত্তম, তবে দু-তিন দিন অন্তর বালি বা কয়লা
বদলে দিতে হয় বা পুড়িয়ে নিতে হবে। আর ঐ যে একটু ফিটকিরি দেওয়া গঙ্গা তীরস্থ
গ্রামের অভ্যাস, তা সকলের চেয়ে ভাল বলে লেখক বলেছেন। কারণ ফিটকিরির গুড়ো যথাসম্ভব
মাটির ময়লা ও রোগের বীজ সঙ্গে নিয়ে আস্তে আস্তে তলিয়ে যান। গঙ্গাজল জালায় পুরে
একটু ফিটকিরির গুঁড়ো দিয়ে থিতিয়ে যে আমরা ব্যবহার করি, বিলিতি ফিলটার চোদ্দ পুরুষের মাথায় ঝাঁটা মারে, কলের জলের দুশো বাণান্ত করে। তবে জল ফুটিয়ে নিতে পারলে নির্ভয় হয়
বটে। ফিটকিরি থিতাম জল ফুটিয়ে ঠাণ্ডা করে ব্যবহার কর, ফিলটার মিলটার খানায় ফেলে দাও। এখন আমেরিকায় বড় বড় যন্ত্রযোগে
জলকে একদম বাষ্প করে দেয়, আবার সেই বাষ্পকে জল করে। তারপর আর একটা যন্ত্র দ্বারা বিশুদ্ধ বায়ু
তার মধ্যে পুরে দেয়, যে বায়ুটা বাষ্প হবার সময় বেরিয়ে যায় সেই জল অতি বিশুদ্ধ, ঘরে ঘরে এমন তাই দেখা যায়।
(চ) ‘আহার ও পানীয়’ রচনাটিতে স্বামীজি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের খাদ্যাভাসের যে তুলনা
করেছেন তা নিজের ভাষায় লেখো?
উত্তরঃ ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ গ্রন্থের ‘আহার ও পানীয়’ প্রবন্ধে স্বামী বিবেকানন্দ প্রথমে
ভারতবর্ষের খাদ্যাভাসের এক মূল্যায়ন প্রস্তুত করে তারপর পাশ্চাত্যের খাদ্যাভ্যাস
নিয়ে আলোচনা করেছেন। খাদ্য সম্বন্ধে ভারতীয়দের দর্শন সমর্থিত দৃষ্টিভঙ্গিই
প্রচলিত। এই দেশে আহার শুদ্ধ হলে মন শুদ্ধ হয় বলে ধরা হয়, আর মন শুদ্ধ হলে আত্মসম্বন্ধীয় অচলা স্মৃতি লাভ হয়। বিশুদ্ধ আহার
খেলেই দেহের ইন্দ্রিয়গুলো কার্যক্ষমতা প্রাপ্ত হয়। আর কদর্য আহারে দেহের
ইন্দ্রিয়গুলোর কার্যক্ষমতা বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাই শারীরিক ও মানসিক অবস্থার
উপযুক্ত বিকাশের জন্য উপযুক্ত খাদ্য নির্বাচনের গুরুত্ব থেকেই এই খাদ্যের বিচার
হয়েছে।
আহার সম্পর্কে
রামানুজাচার্য এক দার্শনিক মতবাদের নিদর্শন দিয়েছেন। খাদ্যের জাতি দোষ, আশ্রয় দোশ, এবং নিমিত্ত দোষ থেকে দূরে থাকার বিধান দিয়েছেন। জাতিদোষ হল খাদের
মধ্যে জাতিগত দোষ। যেমন – পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি উত্তেজক দ্রব্য খেলে মনে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। তাই
প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় সমাজে আমিষ ও নিরামিষ আহারের উপযোগিতা নিয়ে বিবাদ চলে
এসেছে। মাংসাহার নিয়ে ভারতীয় সমাজে এক দ্বিমত প্রচলিত। আমিষ ও নিরামিষ আহারের
সপক্ষে এবং বিপক্ষে পরস্পর বিরোধী নানা যুক্তি তর্কের বিচার করে স্বামীজি বলেছেন “মাংস খাওয়া অবশ্য অসভ্যতা, নিরামিষ ভোজনই অবশ্যই পবিত্রতর।
যাঁর উদ্দেশ্য কেবল ধর্মজীবন, তাঁর পক্ষে নিরামিষ, আর যাকে খেটেখুটে এই সংসারের দিবারাত্রির প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য
দিয়ে জীবন তরী চালাতে হবে তাকে মাংস খেতে হবে বইকি।”
আর পানীয়
গ্রহণের ক্ষেত্রেও স্বামীজি সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছেন। কারণ অশুদ্ধ ভোজনের
সঙ্গে সঙ্গে অশুদ্ধ জল ও রোগের উৎপত্তির কারণ। পাশ্চাত্যে জল শুদ্ধির জন্য
ফিল্টারের প্রচলন বহুল। কিন্তু স্বামীজি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে বুঝতে পেরেছিলেন যে ফিলটারের দিন শেষ
হয়েছে। কারণ ফিলটার জল ছাকতে পারে; কিন্তু জলে দ্রবীভূত রোগ জীবাণুকে
প্রতিহত করতে পারে না, উপরন্তু ফিলটারটি স্বয়ং ঐ রোগ জীবাণুর বাসা হয়ে ওঠে। এ সম্পর্কে
তিনি দেখি ফিল্টারকেই উত্তম বিবেচনা করেছেন। তবে বালি কয়লা ইত্যাদি দুই তিনদিনের
ব্যবধানে বদলে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
খাদ্যাভাস
সম্পর্কে স্বামীজি পাশ্চাত্যের প্রসঙ্গে বলেছেন যে পাশ্চাত্যের গরীব দেশ এবং ধনী দেশের
গরীব শ্রেণি রুটি ও আলুকে প্রধান আহার গ্রহণ করেছেন। মাংসের চাটনি তারা কালে ভদ্রে
গ্রহণ করে। স্পেন, ইতালি, পৌর্তুগাল দেশে প্রচুর পরিমাণে দ্রাক্ষারস সেবন করে পুষ্টি সংগ্রহ
করে। খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে দেখা যায় সব দেশের যে শস্য প্রধান ফসল, সেটাই আসলে গরীবদের খাদ্য। তবে ধনীদের ক্ষেত্রে তা ব্যতিক্রম হয়।
আমেরিকার খাদ্যাভাসে মাছ-মাংসের প্রধান্য আর ভাত ও রুটি চাটনির মতো। আমেরিকানরা
তিনবার ভোজনে মাংসকেই উপযুক্ত মনে করেন। পাশ্চাত্যের ডিনারে প্রথমে নোনা মাছ, ডিম ও চাটনি সবজি গ্রহণ করা হয়। তারপর সূপ এবং পরস্পর থালা বদলে ফল, মাছ, মাংসের তরকারি, মাংস কাঁচা সবজি, মিষ্টান্ন ইত্যাদি পরিবেশন করা হয়।
অতিরিক্ত প্রশ্নোত্তরঃ
১। ‘আহার ও পানীয়’ গল্পটির লেখক কে?
উত্তরঃ ‘আহার ও পানীয়’ গল্পটির লেখক স্বামী বিবেকানন্দ।
২। শঙ্করাচার্যের মতে ‘আহার’ শব্দের অর্থ কি?
উত্তরঃ শঙ্করাচার্যের
মতে ‘আহার শব্দের অর্থ হ’ল ইন্দ্রিয়লব্ধ বিষয়জ্ঞান।
৩। রামানুচার্যের মতে আহার শব্দের অর্থ কি?
উত্তরঃ
রামানুচার্যের মতে আহার শব্দের অর্থ হচ্ছে ভোজ্যদ্রব্য।
৪। প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত কোন দুটো মহাবিবাদ ছিল?
উত্তরঃ
প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত আমিষ ও নিরামিষ এই দুটো মহাবিবাদ ছিল।
৫। ধনী দেশেৰ গরিবদের মধ্যে প্রধান খাদ্য কোনটি?
উত্তরঃ ধনী দেশেৰ
গরিবদের মধ্যে প্রধান খাদ্য হচ্ছে রুটি এবং আলু।
৬। ভারতবর্ষের অন্যান্য অবস্থাপন্ন লোকের জন্য কোন খাদ্য ছিল?
উত্তরঃ
ভারতবর্ষের অন্যান্য অবস্থাপন্ন লোকের জন্য গমের রুটি এবং ভাত ছিল।
৭। ফরাসীদের খাওয়ার ধরণ কেমন?
উত্তরঃ ফরাসীদের
খাওয়ার ধরণ হচ্ছে সকালবেলা কফি এবং এক আধ টুকরো রুটি-মাখন, দুপুরবেলা মাছ মাংস ইত্যাদি মধ্যবিত্ত, রাত্রে লম্বা খাওয়া।
৮। এস্কুইমো জাতি কোথায় বাস করে?
উত্তরঃ এস্কুইমো
জাতি বরফের মধ্যে বাস করে।
৯। বাংলাদেশে ও পাঞ্জাবে মাংসের নাম কি?
উত্তরঃ বাংলাদেশে
ও পাঞ্জাবে মাংসের নাম হচ্ছে মহাপ্রসাদ।
১০। ইহুদীদের এবং হিন্দুদের কোন সম্বন্ধে সৌসাদৃশ্য?
উত্তরঃ ইহুদীদের
এবং হিন্দুদের খাওয়া সম্বন্ধে সৌসাদৃশ্য।
১১। রাজপুতদের মধ্যে কি খাওয়া ধর্ম বিশেষ?
উত্তরঃ রাজপুতদের
মধ্যে বুনো শোর শিকার করে খাওয়া ধর্ম বিশেষ।
১২। কাশ্মীরীরা কি সুখে খায়?
উত্তরঃ
কাশ্মীরীরা বুনো হাসের ডিম পেলে সুখে খায়।
১৩। খাম্বীর শব্দের অর্থ কী?
উত্তরঃ খাম্বীর
হচ্ছে খাদ্যকে সুগন্ধযুক্ত ও সুস্বাদু করার জন্য কাঁঠাল, আনারস ইত্যাদি ফল পচিয়ে তৈরি করা একরকম রস।
শব্দার্থ :
অন্ন – ভাত।
বিষলড্ডুক – বিষের লাড্ডু।
হিদু – হিন্দু।
অজীর্ণ – হজম না হওয়া।
ফটকিরি-থিতান – ফিটকিরি দেওয়া।
চৈতন্যদেব – বৈষ্ণব মহাপুরুষ, গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক।
মনু – প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ‘মনুসংহিতা’-প্রণেতা।
দ্বিশফ – দ্বিখণ্ডিত ক্ষুর-বিশিষ্ট প্রাণী।
বৃথা-মাংস – যে মাংস দেবতার উদ্দেশ্যে বলিপ্রদত্ত নয়।