Chapter-10 লজ্জাবতী
প্রশ্নোত্তরঃ
১। অতি সংক্ষিপ্ত উত্তরের জন্য প্রশ্ন :
(ক) ‘লজ্জাবতী’ কার লেখা?
উত্তরঃ ‘লজ্জাবতী’ স্বর্ণকুমারী দেবীর লেখা।
(খ) লজ্জাবতীর ননদের নাম কী?
উত্তরঃ লজ্জাবতীর ননদের নাম ফুলকুমারী।
(গ) ফুলকুমারী বিয়ের কতদিন পর বাপের
বাড়ি এসেছিল?
উত্তরঃ ফুলকুমারী চৌদ্দ বছর পর বাপের বাড়ি এসেছিল।
(ঘ) হরিমোহন ঘোষের মেয়ে আমি’ কে এই কথা বলেছে?
উত্তরঃ এই কথা ফুলকুমারীর শ্বাশুড়ী বলেছে।
(ঙ) লজ্জাবতীর মেয়ের নাম কী?
উত্তরঃ লজ্জাবতীর মেয়ের নাম পুঁটুরাণী।
(চ) লজ্জাবতীর স্বামীর নাম কী?
উত্তরঃ হেম।
২। সংক্ষিপ্ত উত্তরের জন্য প্রশ্নঃ
(ক) ‘তা দেখো বৌমা, বড় মানুষের বৌ এতদিন পরে আসছে, যত্নের যেন কিছু কম না হয়।”
— কার উক্তি ? বড় মানুষের বউ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে?
উত্তরঃ উক্তিটি লজ্জাবতীর শ্বাশুড়ীর।
বড় মানুষের বউ বলতে লজ্জাবতীর ননদ ফুলকুমারীকে বোঝানো হয়েছে।
(খ) “ও আবার কি সোহাগীপণা” – কে, কাকে, কেন একথা বলেছে?
উত্তরঃ বড় বৌ লজ্জাবতীকে একথা বলেছে।
ফুলকুমারী চৌদ্দ বছর পর পিত্রালয়ে এসেছে। লজ্জাবতী বিয়ে হয়ে আসার
পর অবধি ননদ ফুলকুমারীকে দেখেনি। তাই ফুলকুমারীকে দেখে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে
রান্নাঘরে ঢুকে খানিকটা হলুদ নিয়ে বড় বৌয়ের পিঠে রাঙিয়ে দিল। ফলে বড় বৌ
লজ্জাবতীর এই কাণ্ড কীর্তিতে রেগে গিয়ে এই কথাটি বলেছে।
(গ) ঠাকুরঝি ক্ষেপেছ নাকি?” ঠাকুরঝির নাম কী? কে তাকে কেন একথা বলেছে?
উত্তরঃ ঠাকুরঝির নাম ফুলকুমারী।
লজ্জাবতী ঠাকুরঝিকে একথা বলেছে। কারণ লজ্জাবতী সারারাত লেপ গায়ে না
দিয়ে ঠাণ্ডায় কেঁপে কেঁপে ঘুমিয়েছে। তাই তার জ্বর এসেছে। আসলে শ্বাশুড়ী
লজ্জাবতীর লেপটি মেয়ে ফুলকুমারীর জন্য দাসীকে দিয়ে আনিয়েছিলেন পরিবর্তে অন্য
একটি ছেড়া লেপ দিবেন লজ্জাবতীকে গায়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু দাসী সেই ছেড়া লেপটি
এনে রাখতে ভুলে গিয়েছিল আর ফুলকুমারী এতসব ঘটনা কিছুই জানে না। তাই লেপ ছাড়াই
ঠাণ্ডায় ঘুমিয়ে জ্বর এসেছে তার। আর ফুলকুমারী যখন জানতে পারল লজ্জাবতীর জ্বর
এসেছে তখন সে লজ্জাবতীকে বলল ঘুমিয়ে থাকার জন্য। কিন্তু লজ্জাবতী যখন বলল যে
শুয়ে থাকলে তো তার চলবে না, কারণ রান্না করার পালা সেদিন তার।
তখন ফুলকুমারী বলেছিল সে নিজে রান্না করবে তখন লজ্জাবতী উক্ত কথাটি বলেছে।
৩। দীর্ঘ উত্তরের জন্য প্রশ্ন (প্রতিটি প্রশ্নের মূল্যাংক ৪/৫)
(ক) “বড় মানুষের ঝি। একটা নেপ দিয়েছিলুম তা ফেরত দেওয়া হয়েছে?” কাকে উদ্দেশ্য করে কে এই কথা বলেছেন? প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ঘটনাটি বিশদ করো।
উত্তরঃ লজ্জাবতীকে উদ্দেশ্য করে লজ্জাবতীর শ্বাশুড়ী মাতা এই কথা
বলেছেন।
লজ্জাবতীর ঠাকুরঝির বিয়ে হয়েছে অবস্থাসম্পন্ন ধনী ঘরে। বিয়ের
চৌদ্দ বছর পর ফুলকুমারী প্রিত্রালয়ে এসেছে। তাই শাশুড়ী মেয়েকে গায়ে দেওয়ার
জন্য লজ্জাবতীর লেপটি দাসীকে দিয়ে আনিয়েছেন ৷ কিন্তু লজ্জাবতী তা জানে না।
পরিবর্তে লজ্জাবতীকে একটা ছেঁড়া লেপ দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু দাসী তা দিতে ভুলে গিয়েছিল। আর রাতে ঘুমানোর সময় লেপ না
পেয়ে লজ্জাবতী লেপ ছাড়াই ঘুমিয়েছিল। ফলে সারারাত ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে
লজ্জাবতীর জ্বর আসে। লজ্জাবতীর জ্বর দেখে ননদ ফুলকুমারী একপ্রকার
জোর করে নিজের ইচ্ছায় লজ্জাবতীর ভাগের রান্নার কাজটি করতে গিয়েছিল। কিন্তু
বড়লোকের স্ত্রী হওয়ার ফলে অনভ্যাসবশত রান্না করতে গিয়ে গরম ডালে পা পুড়িয়ে
ফেলে। এই দেখে লজ্জাবতীর শ্বাশুড়ী ছোট বৌকে গালাগাল করেন। তখন অসুস্থ শরীরেই লজ্জাবতী বাকী
রান্নাটা করে সকলকে খাইয়ে দাইয়ে যখন গিয়ে শুয়েছে তখন সে জ্বরে এতটাই কাতর হয়ে
পড়ে যে পরদিন আর বিছানা থেকে উঠতে পারে না। তবে শ্বাশুড়ী মনে মনে বুঝতে
পেরেছিলেন লেপ গায়ে না দিয়ে ঘুমানোর জন্যই লজ্জাবতীর জ্বর হয়েছে। অবচেতনে নিজের
দোষ বুঝতে পরে, সকলের থেকে নিজের দোষকে চাপা দেওয়ার চেষ্টায় আলোচ্য উক্তিটি করেন।
(খ) লজ্জাবতীর চরিত্র চিত্রণ করো।
উত্তরঃ ঊনিশ শতকের মহিলা উপন্যাসিকদের মধ্যে একজন স্বনামধন্য লেখিকা
স্বর্ণকুমারী দেবী। উনিশ শতকের বঙ্গ দেশে অধিকাংশ নারীই স্বামীগৃহে অত্যাচারিত
ছিলেন। ‘লজ্জাবতী’ গল্পটি তারই একটি উদাহরণ। লজ্জাবতী তার পিতা ও মাতার খুব আদরের
সন্তান ছিল। লজ্জাবতীর আসল নাম লজ্জাবতী ছিল না। ছোটবেলা থেকেই সে খুব আদুরে ছিল, পিতা মাতা বকলে সে লজ্জাবতী লতার মতো সঙ্কুচিত হয়ে জড় সড় হয়ে
পড়ত। তার ছোট ফর্সা মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠত। সে কান্না লুকিয়ে হাসির চেষ্টা
করলে, হাসি ও কান্নায় মিলে তার মুখখানির মাধুর্য্য এত বেড়ে যেত প্রত্যেকে
তাকে লজ্জাবতী নাম দিয়েই ডাকত। কিন্তু বিয়ের পর শশুরবাড়িতে এসে লজ্জাবতী তার এই
স্বভাবের জন্য প্রতিপদে তাড়না সহ্য করেছে। কারণ লজ্জাবতী প্রশংসার কাজ করেও যেমন
উচ্ছাসিত হতে পারে না, তেমনি অন্যায় অত্যাচারে প্রতিবাদ করতে পারে না। তাই লাঞ্ছনা সহ্য
করে।
লজ্জাবতীর বিয়ে হয়েছে বারো বছর, এই বারো বছরেও লজ্জাবতীকে নতুন বৌ
বলেই মনে হয় কেননা সে এতই সহজ-সরলা। এই লজ্জাবতীর একটি মেয়ে পুঁটুরাণী।
লজ্জাবতীর শাশুড়ী লজ্জাবতীকে অনেক কটু ভাষণে বিদ্ধ করে। লজ্জাবতীর ননদ ফুলকুমারী
চৌদ্দ বছর পর পিতৃগৃহে প্রথমবার এসেছে। আর তাই তার জন্য আনন্দের আয়োজন করা
হয়েছে। ফুলকুমারীকে দেখার জন্য লজ্জাবতী উচ্ছ্বসিত। কারণ এই প্রথমবার সে
ফুলকুমারীকে দেখছে, এবং ননদের রূপ দেখে তার সঙ্গে দুদণ্ড কথা বলার জন্য সে উদ্বেলিত হয়ে
উঠেছে। কিন্তু সেই সুযোগ তার হয়ে উঠে না। আর তার মধ্যে তার মেয়ে পুঁটুরাণী তার
চুলের ফিতে ও কাটা হারিয়ে ফেলেছে। এই নিয়ে বাড়িতে গণ্ডগোল বেঁধেছে। কারণ
পুঁটুরাণী এর জন্য দায়ী করেছে তার মা’কে। কারণ তার মা লজ্জাবতী যখন বসে
সবজি কুটছিল তখন তার পাশে পুটুরাণী ফিতে কাটা রেখে এসেছিল। কিন্তু লজ্জাবতী তা
জানত না। আর এই নিয়ে বাড়িতে যখন গণ্ডগোল বাধে তখন প্রত্যেকেই লজ্জাবতীকে দোষারোপ
করে। লজ্জাবতীর শ্বাশুড়া তাকে বলেছে যে সে ইচ্ছা করেই এই অলক্ষণে গয়না হারানোর
কাজটি করেছে। এর পরেও লজ্জাবতী কিছু বলেনি কারণ সে প্রতিবাদ জানে না। তাই
শুধুমাত্র শ্বাশুড়ীকে বোঝাতে চেয়েছিল যে গয়নাটি তার বাবার দেওয়া তাই
পুঁটুরাণীর শ্বশুরবাড়ির কথা শোনার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু লজ্জাবতীর শ্বাশুড়ী
এই কথাটিকে নিয়ে ছোটো বৌকে যেমন গালি-গালাজ করত তাতেও লজ্জাবতী কোনো প্রতিবাদ করল
না। এমনকী লজ্জাবতীর স্বামী হেমকেও শ্বাশুড়ী সামান্য ঘটনাটিকে রং মাখিয়ে পরিবেশন
করল এবং ছেলেকে বললেন তাকে কাশী পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য। মায়ের মুখের নালিশ শুনে
লজ্জাবতীর স্বামী লজ্জাবতীকে গালিগালাজ করল এমনকী বিরক্তি প্রকাশ করে বলল যে সে যে
পশ্চিমে যাচ্ছে সেখান থেকে যেন আর ফিরে না আসে।
স্বামীর এই অন্যায় ব্যবহার লজ্জাবীতকে মর্মাহত করে। সে স্বামীকেও
সম্পূর্ণ ঘটনাটা খুলে বলতে পারে না শুধু অঝোরে কেঁদে ভাসায়। কিন্তু ননদ
ফুলকুমারীর সৌজন্য স্বামী তার ভুল বুঝতে পেরে ফুলকুমারীকে পুনরায় আদর ভালবাসায়
ভরিয়ে দিয়ে, কর্মের উদ্দেশ্যে পশ্চিমে চলে যায়। আর লজ্জাবতী স্বামীর এই সুখপূর্ণ
ব্যবহারের কারণ খুঁজতে গিয়ে ফুলকুমারীর ভালোবাসাকেই খুঁজে পায়। শ্বশুড়বাড়ির
একমাত্র এই মানুষটি তাকে সম্পূর্ণ বুঝেছে এবং স্নেহে যত্নে লজ্জাবতীর হৃদয় ভরিয়ে
তুলেছে। কিন্তু লজ্জাবতীর তার ননদের সঙ্গে সখীত্বের সম্পর্ক বেশিদিন পর্যন্ত ধরে
রাখতে পারেনি কারণ তার অনেক আগেই লজ্জাবতী ইহলোক ত্যাগ করে চলে যায়। লজ্জাবতীর
মৃত্যুর পেছনে অনেকটা দায়ী তার শ্বাশুড়ী।
কারণ শ্বাশুড়ী নিজের মেয়েকে লজ্জাবতীর গায়ে দেওয়ার লেপটি
দিয়েছিল। পরিবর্তে একটা ছেড়া লেপ লজ্জাবতীকে দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু দাসী তা
রেখে আসতে ভুলে গেছিল। আর লজ্জাবতী তার স্বভাবগুণে লেপের কোনো খোজ খবর না করে লেপ
ছাড়াই ঠাণ্ডায় ঘুমিয়েছে। এবং ঠাণ্ডায় তার জ্বর এলে সে বিছানা থেকে উঠতে পারে না।
তবুও সে জ্বর শরীরেই রান্নার কাজ করতে গেলে ননদ তার ভাগের কাজটি করে। ফলে এর ফলেও
তাকে শাশুড়ী থেকে কথা শোনতে হয়।
(গ) লজ্জাবতী ও ফুলকুমারীর সম্পর্কের
পরিচয় দাও।
উত্তরঃ লজ্জাবতী ও ফুলকুমারীর মধ্যে ননদ ও বৌদির সম্পর্ক। লজ্জাবতী
বারো বছর ধরে বিয়ে হয়ে শ্বশুর বাড়িতে এসেছে কিন্তু আজ পর্যন্ত সে ননদকে দেখেনি।
কারণ ননদ
ফুলকুমারী চৌদ্দ বছর পর এই প্রথমবারের জন্য বাপের বাড়িতে এসেছে।
ফুলকুমারীর শ্বশুর ঘর অনেক ধনী তাই তাকে গরিব বাবা মায়ের ঘরে আসতে দেননি।
অন্যদিকে লজ্জাবতী এই ননদটিকে নিয়ে অনেক উচ্ছ্বসিত তাই ননদের আসার খবর পাওয়ায়
দিন থেকে সে ব্যাকুল হয়ে আছে। ননদের জন্য আদর অভ্যর্থনার কোনো ত্রুটি সে করেনি।
কিন্তু ভাগ্যদোষে সেদিন এক গণ্ডগোল বাধে তার মেয়ে পুটুরাণীর চুলের ফিতে ও কাটা
হারাণোর ঘটনা নিয়ে। পুটুরাণীর মতে সে তার সামগ্রী মায়ের সামনইে রেখেছিল কিন্তু
লজ্জাবতী তা ঘুণাক্ষরেও জানত না তাই সোণার কাটা হারিয়ে যাওয়ায় শ্বাশুড়ী তাকে
লাঞ্ছনা বঞ্চনা দেন অলুক্ষণে বলেন। কিন্তু লজ্জাবতী তার সহস সরল স্বভাব গুণে কোনো
প্রতিবাদ করতে পারে না। শুধুমাত্র গয়না সম্পর্কে একটি কথাই বলে যে এই গয়না তার
বাবার দেওয়া। আর এই কথার সূত্র ধরেই শ্বাশুড়ী ঘটনাটিকে অনেক বড় রূপ দেয়।
লজ্জাবতীর তার বাপের বাড়ির তুলনা দেওয়ায় শ্বাশুড়ী তার অপমানের প্রতিশোধ তোলে
লজ্জাবতীর স্বামীকে নালিশ করে। এরপর স্বামী ও শ্বাশুড়ীর লাঞ্ছনা সহ্য করেও
লজ্জাবতী চুপ থাকে। নিরুপায় লজ্জাবতী শুধু কেঁদেই ভাসায়। কিন্তু ফুলকুমারী সমস্ত
ঘটনাটি বুঝতে পারে। সে তার মাকেও বোঝানোর চেষ্টা করে কিন্তু মা বৌদ্দির পক্ষ
নেওয়াতে মেয়ের উপর রেগে যায় আর বৌয়ের উপর ও তা বর্ষণ হয়। কিন্তু লজ্জবতীর
তাতেও কোনো বিদ্বেষ নেই। কারণ লজ্জাবতী ফুলকুমারীকে ভালবাসে সে। ফুলকুমারী তার
পক্ষ নিয়ে লজ্জাবতীর স্বামীকে সব কথা বুঝিয়েছে। তাই কৃতজ্ঞতায় তার নয়ন ভরে
যায়। এরপর সারারাত ঠাণ্ডায় লেপ ছাড়া ঘুমিয়ে যখন লজ্জাবতীর জ্বর আসে তখন তার
ভাগের রান্নার কাজটি ফুলকুমারী নিজেই করতে চায় কিন্তু লজ্জাবতী ননদকে মানা করে
রান্না করার জন্য তখন স্নেহপ্রসূতই ফুলকুমারী রাগ করে বলে লজ্জাবতী রান্না করলে সে
খাবে না।” যদিও সে শ্বশুড় বাড়িতে কোনোদিন রান্না করেনি। তাই রান্না করতে
গিয়ে খানিকটা ডাল উথলিয়ে ফুলকুমারীর পায়ে পড়ে গেল আর এই ঘটনায় লজ্জাবতী
ব্যথিত হন। আর সেই সময় শ্বাশুড়ী এসে এই অবস্থা দেখে লজ্জাবতীকে গালি দিয়ে বলেছে
– “বলি সব রাজায় ঝিরা ননদ দু’দিন মাত্র থাকতে এসেছে তাকে না
পুড়িয়ে মনকামনা সিদ্ধি হ’ল না।” এরপর লজ্জাবতী এই অসুস্থ শরীরে সমস্ত কাজকর্ম সেরে যখন লজ্জাবতী আর
চলতে পারছে না তখন সে একেবারে বিছানা নিল। কিন্তু শ্বাশুড়ী লজ্জাবতীর অসুখ করেছে
শুনে বলাবলি করতে থাকল যে সে কাজের নামে অসুখের ভান করছে। কিন্তু ফুলকুমারী তার
মায়ের বিপরীত সে জানে লজ্জাবতীর অসুখ করেছে তাই সে নিজেই তার কাছে গিয়েছে এবং
লজ্জাবতীকে বলেছে সে আর রাগ করবে না কোনোদিন এরপর দুই সখী গলা ধরে কেঁদেছে। এর
কয়েকদিন পর লজ্জাবতী তার সংসারে সমস্ত দুঃখ অবহেলা নিয়ে চিরতরে বিদায় নেয়।
(ঘ) লজ্জাবতীর শ্বাশুড়ীর চরিত্র
চিত্রণ কর।
উত্তরঃ ‘লজ্জাবতী’ গল্পটিতে শ্বাশুড়ী চরিত্রটি একটি নেতিবাচক, কঠোর বিবেকহীন চরিত্র। লজ্জাবতীর শ্বাশুড়ী তার ছেলের বৌ-দের কখনো
ভালোবাসেনি। বিশেষ করে শ্বাশুড়ীর এই কটুবাক্যের শিকার হয়েছে বেশি লজ্জাবতী।
লজ্জাবতী স্বভাবে সহজ সরলা, শত অন্যায় অত্যাচারেও তার কোনো
প্রতিবাদ নেই। সে মুখ বুঝে সব সহ্য করে। লজ্জাবতীর ননদ ফুলকুমারী দীর্ঘ চৌদ্দ বছর
পর প্রথমবারের জন্য বাপের বাড়িতে এসেছে তাই তার আদর আপ্যায়নের কোনোরকম ত্রুটি
যাতে না হয় তার জন্য বৌয়েরা এটস্থ হয়ে কাজ করছে। তবুও শ্বাশুড়ী সন্তুষ্ট নয়।
শ্বাশুড়ীর ধারণা লজ্জাবতী হয়তো ননদকে হিংসে করছে। কিন্তু আসলে লজ্জাবতী যে তার
ননদের আগমনে কতাট উৎফুল্লিত তা তিনি ধারণা করতেই পারেননি। তাই তিনি কখনো লজ্জাবতীকে
বোঝার চেষ্টা করেননি। এমনকী বিনা অপরাধে সবসময় লজ্জাবতীকে অন্যায় অবিচার করেছেন।
না জেনে না বুঝেই লজ্জাবতীকে গালি-গালাজ করেছেন। আর শ্বাশুড়ীর এই অন্যায় অত্যাচার
ও অবহেলায় জর্জরিত লজ্জাবতী ইহলোক ছেড়ে চলে যায়। কারণ ফুলকুমারী যখন তার বাপের
বাড়িতে এসেছে তখন তাকে গায়ে দেওয়ার জন্য শ্বাশুড়ী লজ্জাবতীর গায়ের লেপটা এনে
দিয়েছিল। আর লজ্জাবতীকে গায়ে দেওয়ার জন্য একটি ছেড়া লেপ দাসীকে দিয়ে
পাঠিয়েছিল কিন্তু দাসী তা লজ্জাবতীর ঘরে রেখে আসতে ভুলে গেছে। আর অন্যদিকে
লজ্জাবতী এসবের কিছুই জানে না। তাই সে লেপ ছাড়াই ঘুমিয়ে পড়ে। তাই ঠাণ্ডায় রাত্রে
তার জ্বর আসে। আর এই জ্বরে লজ্জাবতীকে এতটা অসুস্থ করে যে সে বিছানা থকে উঠতে পারে
না। অথচ শাশুড়ী তাকে সহানুভূতি দেখানোর বদলে লজ্জাবতীকে উল্টো কথা শোনায় যে
ননদকে লেপ দেওয়াতে সে জেদ করে ছেড়া লেপ গায়ে না দিয়ে জ্বর বাঁধিয়েছে। আসলে যে
সেদিন কোনো লেপই ছিল না লজ্জাবতীর ঘরে, তা শ্বাশুড়ী জানার চেষ্টা করেনি।
আর তাই লজ্জাবতী অসুস্থ হয় এবং এই জ্বর আর সারে না তাই সে চিরনিদ্রায় শায়িত
হয়।
(ঙ) ‘লজ্জাবতী’ গল্পটির নামকরণের সার্থকতা বিচার
করো?
উত্তরঃ ‘লজ্জাবতী’ গল্পটি স্বর্ণকুমারী দেবীর রচিত। কোনো গল্পের নামকরণ হয় তার ঘটনাকে
কেন্দ্র করে, কখনো চরিত্রকে কেন্দ্র করে নামকরণ করা হয় আবার কখনো লেখকের
অভিপ্রায়ে করা হয়। আলোচ্য গল্পটির নামকরণ করা হয় লজ্জাবতীর চরিত্রটিকে কেন্দ্র
করে।
ঊনিশ শতকের বঙ্গদেশে অধিকাংশ নারীই স্বামীগৃহে অত্যাচারিত ছিলেন।
লজ্জাবতী গল্পটি তারই একটি উদাহরণ। গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র লজ্জাবতী।
লজ্জাবতীকে কেন্দ্র করেই সমস্ত ঘটনা এগিয়ে গেছে। লজ্জাবতী বাপের ঘরে যেই আদর
যত্নে থেকেছে শ্বশুড় বাড়ি এসে সেই আদর সে আর কোনোদিন অনুভব করেনি। প্রত্যেকের
থেকে লাঞ্ছনা ও গঞ্জনাই পেয়েছে। লজ্জাবতীর ননদ ফুলকুমারী দীর্ঘ চৌদ্দ বছর পর
প্রথমবার বাপের বাড়িতে এসেছেন। তাই তার আদর আপ্যায়নের মহাসমারোহ চলছে। লজ্জাবতী
তার ননদের আগমনে প্রফুল্লিত। কিন্তু এই প্রফুল্লতা উৎফুল্লতা শ্বাশুড়ী সহ্য করতে পারেননি। তাই ননদের আগমনের
দিন বাড়িতে সামান্য ঘটনা নিয়ে এক বিরাট গণ্ডগোল বাঁধে। সামান্য ঘটনাটি ছিল
লজ্জাবতীর মেয়ে তার চুলের কাটা ও ফিতে মায়ের সামনে রেখে এসেছিল যেটা পরবর্তীতে
হারিয়ে যায়। সেই নিয়ে গয়না হারানোর দোষে দোষী সাব্যস্ত লজ্জাবতীকে অনেক
লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়। প্রথমত শ্বাশুড়ী যখন বলেন যে পুঁটুরাণীকে আর পরের বাড়ি
পাঠানো যাবে না কারণ শ্বশুররা যখন বলবে আমাদের গহনা কি হলো তখন লজ্জায় না মুখ
কালী হয়ে যাবে।” শ্বাশুড়ীর এই বক্তব্যে লজ্জাবতী মুখ মৃদুস্বরে বলেছিল যে গয়নাটা
হারিয়েছে সেটা তার বাবা তাকে দিয়েছিলেন আর পুটুরাণীকে সে সেটাই পরিয়ে দিয়েছিল।
লজ্জাবতীর এই সামান্য উত্তরটিকে শ্বাশুড়ী অনেক বড় রূপ দিয়ে ঘটনাটিকে বিকৃত করে
তুলেন। লজ্জাবতী স্বামী হেমকে শ্বাশুড়ী ঘটনার সম্পূর্ণ বৃত্তান্ত না বলে এমন ভাবে
কথাটাকে প্রদর্শন করেন যেন লজ্জাবতী শ্বাশুড়ীকে অপমান করেছেন। তাই তিনি ছেলেকে
বলছেন তিনি কাশী চলে যাবেন। আর এই ঘটনায় ছেলে ক্রোধান্বিত হয়ে স্ত্রীকে না বুঝেই
গালি-গালাজ করে। ঘটনাচক্রে সেদিনই হেমের পশ্চিমে যাওয়ার কথা ছিল তাই সে স্ত্রীকে
ক্রোধের বসে বলে ফেলে আর ফিরে না আসার কথা। এতে লজ্জাশীলা সরলা লজ্জাবতী স্বামীকে
কিছুই বলতে না পেরে শুধু কান্নায় ভেসে যায়। সচেতন ও বিবেকসম্পন্ন ননদ এই ঘটনার
ভুল বোঝাবুঝিকে শুধরে দেওয়ার জন্য দাদাকে ঘটনাটি খুলে বলে এবং লজ্জাবতী যে
নির্দোষ সে কথাও জানায়। এরপর লজ্জাবতীর স্বামী নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জাবতীকে
আদরে ভরিয়ে দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে। এরপর লজ্জাবতী যখন জানতে পারে স্বামীর ভুল
ধারণা শুধরে দিয়েছে তার ননদ, তখন সে কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়।
এরপর লজ্জাবতী তার স্বামীর স্নেহসুখ ও ননদের ভালবাসায় কৃতজ্ঞতায় আর
বেশি আনন্দিত হতে পারল না। কারণ সেই রাত্রে লজ্জাবতী ঘুমাতে গিয়ে দেখে তার গায়ের
লেপটি নেই তখন সে ভেবেছে যে দাসী হয়তো তা শুকাতে দিয়ে তুলে আনতে ভুলে গেছে।
কিন্তু আসলে ঘটনা ছিল অন্য রকম। সে বিষয়ে লজ্জাবতীর কোনো ধারণাই ছিল না। ঘটনাটি
ছিল এইরকম যে শ্বাশুড়ী তার মেয়েকে গায়ে দেওয়ার জন্য লজ্জাবতীর লেপটি দিয়েছিল
এবং পরিবর্তে একটা ছেড়া লেপ তাকে দিয়েছে কিন্তু দাসী তা লজ্জাবতীর ঘরে এনে রাখতে
ভুলে যায়। ফলে সারা রাত লেপ গায়ে না দিয়ে ঠাণ্ডায় ঘুমিয়ে পরের দিন অসুস্থ
হয়। আর লজ্জাবতীর এই জ্বর এতটাই তাকে কাবু করে ফেলে যে সে বিছনা থেকে উঠতে পারে
না। এর কারণও তার যথেষ্ট বিশ্রামের অভাব। অর্থাৎ এই জ্বর নিয়েও সে
যথেষ্ট কাজ করে রান্নাবান্না সময় করে। যদিও ফুলকুমারী তার কাজের ভারটা নিজের
দায়িত্বে নিয়ে রান্না করতে গিয়ে পা পুড়িয়ে ফেলায় শ্বাশুড়ী তার জন্যও ছোট
বৌকে দোষারোপ করে। আর কোনো ধরনের সমবেদনা করে না। পরে ধীরে ধীরে এই জ্বর তাকে এত আক্রান্ত করে যে
লজ্জাবতী আর সুস্থ হয়ে উঠতে পারল না। তাই একেবারে চিরতরে বিদায় নেয়।
সুতরাং সমস্ত গল্পটির আরম্ভ থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত সম্পূর্ণ ঘটনা
লজ্জাবতীকে কেন্দ্র করে ঘটেছে। আর লজ্জাবতী তার নামের মতোই লজ্জাশীলা। আর অতিরিক্ত
লজ্জাশীলা স্বভাবের জন্যই তার জীবনের এই করুণ পরিণতি ঘটে। সুতরাং নামকরণটি সার্থক
হয়েছে।
অতিরিক্ত প্রশ্নোত্তরঃ
১। ” লজ্জাবতী গল্পটির লেখক কে?
উত্তরঃ লজ্জাবতী গল্পটির লেখক স্বর্ণকুমারী দেবী।
২। লজ্জাবতীর বয়স কত?
উত্তরঃ লজ্জাবতীর বয়স দ্বাদশ বৎসর।
৩। ‘শুনেছ ফুলকুমারী আসছে’ — কে, কাকে বলেছে?
উত্তরঃ আলোচ্য উক্তিটির বক্তা লজ্জাবতীর শ্বাশুড়ী। তিনি লজ্জাবতীকে
এ কথাটি বলেছেন।
৪। ফুলকুমারীর বিবাহের কত বৎসর হয়েছে?
উত্তরঃ চতুর্দশ বৎসর হয়েছে ফুলকুমারীর বিবাহের।
৫। লজ্জাবতীর ঠাকুরঝির নাম কি?
উত্তরঃ লজ্জাবতীর ঠাকুরঝির নাম ফুলকুমারী।
৬। “কাজের সময় ওসব ন্যাকামি ভাল লাগে
না, কি হাসি পেয়েছে।” বক্তা কে?
উত্তরঃ আলোচ্য উক্তিটির বক্তা বড় বৌ এর।
৭। ছোট বউ গহনা ছাড়া আর কি হারিয়েছিল?
উত্তরঃ ছোট বউ গহনা ছাড়া চেলির কাপড় হারিয়েছিল।
৮। ‘তিনি কিছু বললে আমার বড় কান্না
পায়” — এখানে তিনি কে?
উত্তরঃ এখানে তিনি হচ্ছেন ফুলকুমারীর দাদা।
৯। “মায়ের বড় অসুখ করেছে সে শুয়েছে
পড়েছে?” – বক্তা কে?
উত্তরঃ আলোচ্য উক্তিটির বক্তা পুটুরাণী।
১০। কার পায়ে ডাল পড়েছিল?
উত্তরঃ ফুলকুমারীর পায়ে ডাল পড়েছিল।
শব্দার্থঃ
নবীন – ননী, মাখন।
অধীর চরণ – চঞ্চল পায়ে।
হেঙ্গাম – হাঙ্গামা।
বিদীর্ণ – ছিন্ন, খণ্ডিত, ভগ্ন।
প্রবিষ্ট – যে প্রবেশ করেছে।
ঘূর্ণমান – যাকে ঘোরানো হচ্ছে, যা সমানে ঘুরছে।